রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৯ অপরাহ্ন

কক্সবাজার শহরের জলাবদ্ধতার নেপথ্যে ৫৮৬ কোটি টাকার দুই সড়ক প্রকল্প

নুপা আলম : বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত শহর কক্সবাজারের পর্যটন জোন বলা হয় কলাতলীর হোটেল-মোটেল এলাকাকে। যেখানে কখনও জলাবদ্ধতা না দেখলেও গত ৩ মাসে ৪ দফায় জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে। সর্বশেষ শুক্রবার সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতে পানিতে ডুবে যায় পর্যটন জোন কলাতলীর হোটেল মোটেল এলাকার সকল সড়ক, সৈকত সংলগ্ন এলাকা, মাকের্ট এলাকা। একই সঙ্গে কক্সবাজার শহরের পাঁচ কিলোমিটারের প্রধান সড়কও পানিতে ডুবেছে। সড়কের বাজারঘাটা, বড়বাজার, এন্ডারসন সড়ক, টেকপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকা, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, গোলদিঘিরপাড় এলাকার দোকান, অফিস-আদালত ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বৃষ্টির পানি জমে যায়। হাজারো ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে।

এই জলাবদ্ধতা কখন দেখেননি কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার।

তিনি বলেন, ভারী বর্ষণ হলেই হোটেল মোটেল জোনে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ৪ লেনের সড়ক নিমার্ণ এর জন্য দায়ি। সড়কটি নিমার্ণ করার সময় আগের চেয়ে অস্বাভাবিক উচু এবং নালার অংশ ছোট্ট করে ফেলা হয়েছে। একই সঙ্গে নালার উপরে ¯ø্যাব দিয়ে ঢেকে দেয়া হল। সড়কের পানি নালা নেমে যাওয়ার পথও রাখা হয়নি। এর সাথে পাহাড় কাটার মাটি নেমে এসে নালা ভরাট হয়ে গেছে। যা পরিষ্কার করার সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে বৃষ্টিতে পানি দ্রæত সাগর-নদীতে নেমে যেতে পারে না। তাই জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। গত জুলাই মাসেও কয়েক দফায় ভারী বর্ষণ হয়েছিল। তখনো শহরজুড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছিল।

এমন জলাবদ্ধতা দেখেননি কক্সবাজার বাঁচা আন্দোলনের সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আয়াছুর রহমান। তিনি বলেন, লাবণীর মোড় থেকে কলাতলী হয়ে লিংক রোড় সড়কের মতো কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কও একই অবস্থা। এই সড়কটি সংস্কারে সময় গেছে ৩ বছরের বেশি। প্রধান সড়কটি আগের অবস্থার চেয়ে কম হলেও ৩ ফুট উচু করা হয়েছে। এতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মার্কেট নিচে নেমে গেছে। যে নালা করা হয়েছে ওখানে ময়লা আবর্জনায় ভরে আছে। ¯ø্যাব নিয়ে ঢাকা নালা পরিষ্কার করা সুযোগ নেই। সড়ক উচু হওয়া সড়কের দক্ষিণ এলাকার পানি অতিক্রম করে উত্তরের বাঁকখালী নদীতে যাবে তাও সম্ভব না। ফলে ভারী বর্ষণ ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানি নালা দিয়ে নেমে যেতে পারছে না বলেই শহরজুড়ে এমন জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। সড়কের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষের চরম দুর্ভোগ যাচ্ছে।

একই ভাবে কলাতলী ও শহরে জলাবদ্ধতার জন্য দুইটি সড়ককেই দায়ী করেছেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা। তিনি বলেন, অপরিকল্পিত, অস্বাভাবিক উচু, ¯ø্যাব দিয়ে ঢাকা প্রায় ৬ কোটি টাকার সড়ক প্রকল্প এখন জনগনের ভোগান্তির এক মাত্র কারণ। এই সড়কের নালা এখন বন্ধ। পানি নেমে যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা কবলে পড়তে হচ্ছে।

এর মধ্যে লাবণীর মোড় হয়ে কলাতলী-লিংক রোড় ৪ লেনের সড়কটি নিমার্ণ করেছে কক্সবাজার সড়ক ও জনপদ বিভাগ। ২০১৯ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া সড়কটি উদ্বোধন হয় ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজারে সফরে আসা ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কক্সবাজার শহরের লাবনী পয়েন্ট থেকে লিংকরোড পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার সড়ক ৪ লেন করার প্রকল্পটি ছিল ২৮৮ কোটি টাকা।

কক্সবাজার সড়ক ও জনপদ বিভাগের তথ্য মতে, মাঝখানে ১০ ফুট ডিভাইডার, দু’পাশে ৬ ফুট করে ড্রেনসহ সড়কটি প্রশস্ত হয়েছে মোট ৭১ ফুট। ২৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে ৯০ কোটি টাকা জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ বাবদ জমির মালিকদের প্রদান করা হয়েছে। বাকী অর্থ সড়ক নির্মাণে ব্যয় করা হবে।

কক্সবাজার শহরের হলিডের মোড় থেকে বাজারঘাটা হয়ে লারপাড়া বাস টার্মিনাল পর্যন্ত প্রধান সড়কটির সংস্কার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ২৯৮ কোটি ১৪ লাখ ৮৪ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের কাজটি শুরু হয় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে। উদ্বোধন হয় আগের প্রকল্পের সাথেই ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজারে সফরে আসা ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মোটেল লাবণী মাকের্টের ব্যবসায়ী সিফাত জানিয়েছেন, তার প্রতিষ্ঠানে গত ৩ মাসে ৪ বার বৃষ্টির পানি প্রবেশ করেছে। সড়কটি নালা বন্ধ হওয়ায় পানি নিষ্কাশনের সুযোগ নেই। উন্নয়ন প্রকল্পের কবলে এমন ভোগান্তি।

কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সমন্বয়ক এডভোকেট রিদুয়ান আলী জানান, প্রধান সড়ক সংস্কার সময়ে জোর প্রতিবাদ এসেছিল অস্বাভাবিক উচু না করতে কিন্তু কেউ শোনেন নি। টাকা দিয়ে সড়ক করে নালা বন্ধ করে ¯ø্যাব দেয়ার কারণে পরিষ্কার করা যায় না। ফলে যা হওয়ার তাই হল। নাগরিকরা ভোগান্তিতে পড়েছেন।

এদিকে, কক্সবাজারে শুক্রবারের তুলনায় শনিবার বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। এ পরিস্থিতিতে কক্সবাজার শহরে জলাবদ্ধ এলাকা থেকে পানি নেমে গেলেও বেড়েছে প্লাবিত এলাকার সংখ্যা। এখনও জেলা সদর সহ ৬ উপজেলার অন্তত ২ শতাধিক গ্রাম পানিবন্দি থাকার তথ্য মিলেছে।

কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারি আবহাওয়াবিদ আব্দুল হান্নান জানিয়েছেন, শুক্রবার বেলা ১২ টা থেকে শনিবার বেলা ১২ টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় মোট বৃষ্টিপাতের পরিমান ২১০ মিলিমিটার। বৃষ্টি কিছুটা কমলেও ভারী বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার বেলা ১২ টা থেকে শুক্রবার বেলা ১২ টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ৫০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। যা কক্সবাজারের ইতিহাসের সর্বোচ্চ বৃষ্টি। এর আগে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ৪৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিল।

বৃষ্টি কমে যাওয়ায় কক্সবাজার শহরের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়েছে। পর্যটন জোন কলাতলীর হোটেল মোটেল এলাকার সকল সড়ক, সৈকত সংলগ্ন এলাকা, মাকের্ট এলাকা থেকে নেমে গেছে পানি। শহরের প্রধান সড়কের বাজারঘাটা, বড়বাজার, মাছবাজার, এন্ডারসন সড়ক, টেকপাড়া, পেশকারপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকা, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, গোলদিঘিরপাড়, তারাবনিয়াছড়া, রুমালিয়ারছড়া, বাাঁচা মিয়ার ঘোনা, পাহাড়তলী এলাকা থেকেও জলবদ্ধতা নেমে গেছে।

তবে শহরের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, নুনিয়াছড়া সহ ৮ টি নি¤œাঞ্চল এখনও পানিবন্দি রয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

.coxsbazartimes.com

Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themesbcox1716222888